Tuesday 29 January 2019

নির্বাচন / ড. মোহাম্মদ আমীন



ইংরেজি ইলেকশন শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নির্বাচন। শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রতিনিধি বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে জনমত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিশেষ। সাধারণত গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। তবে বাছাই অর্থেও নির্বাচন শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণ তাদের প্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সুতরাং, গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি অনিবার্য উপাদান এবং অনিবার্য প্রক্রিয়া। মনে করা হয় Ñ আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণকে সরকারে সামিল করা হয়। এটা কিয়দংশে সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়, তবে বিপুল জনগণকে সরকারের কাজে সম্পৃক্ত করার আর কোনো সহজ উপায় এ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। যতক্ষণ পর্যন্ত তা পারা না যায, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনই হবে গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের অন্যতম উপায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষ মঙ্গল গ্রহে উপনীত হতে পেরেছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে তাদের অগ্রগতি ওই কম্পিউটার পর্যন্ত, ব্যবস্থাপনায় যে মানুষের হার্দিক বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে পর্যন্ত এখনো পৌঁছা সম্ভব হয়নি।

নির্বাচনে সবসময় ভালো লোক বা পছন্দের লোক পাওয়া যাবেÑ তা বলা যায় না। ভালোপ্রার্থী না-থাকুক, না-থাকুক পছন্দের প্রার্থী, যারা আছেন তাদের মধ্য থেকে কম-খারাপকে পছন্দের একটা সুযোগ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় থেকে যায়। তাই এটাকে অনেকে মন্দের ভালো বলে অভিহিত করেন, যা ভোট না হলে পাওয়া যায় না। সাধারণভাবে প্রত্যেকে ভালো লোকটাকে নির্বাচিত করতে চান, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে ওই ভালো লোকটা নির্বচানে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন না বা করার সুযোগ পান না। শুধু উন্নয়নশীল দেশে নয়, উন্নত দেশের ক্ষেত্রেও কথাটি কম প্রযোজ্য নয়। ভালো লোকের যদি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুযোগ পেত তাহলে নিশ্চয় গণতন্ত্র আরও অর্থবহ হতো। তবে, ভালো লোক কে? কী তার বৈশিষ্ট্যÑ এ নিয়ে কোনো সর্বজনবাদিসম্মত সংজ্ঞার্থ নেই। এটি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক একটি ধারণা, যা দল, ব্যক্তি, ধর্ম বা অন্য আরো অনেক বিষয়ভেদে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ডেমোক্র্যাটদের কাছে সবচেয়ে ভালো লোকটি রিপাবলিকানের কাছে হয়ে যেতে পারে সবচেয়ে মন্দ লোক। তাই ভালো মন্দ নয়, নির্বচানে যে বেশি ভোট পায় সেই নির্বাচিত হয়, তাত্ত্বিকভাবে তাকে পছন্দের লোক মনে করা হয়। এখানেই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। কারচুপি করে নির্বাচিত হলেও এমন অপরাধ করে জয়ী হয়ে আসা লোকই হয় জনপ্রতিনিধি।
তারপরও, আমি মনে করি, প্রত্যেক নাগরিকের নির্বাচনে ভোট দেওয়া উচিত, তাহলে একদিন প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করবে। তখন, যারা কেবল শক্তি আর অর্থ দিয়ে নির্বচানে জিতে আসতে চায় তাদের পরাজয় ঘটবে। আপনি যদি গণতন্ত্র চান আপনাকে অবশ্যই নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। যদি আপনি নির্বাচনকে অবহেলা করেন, নানা অজুহাত তুলে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে না যান, তাহলে আপনার অভিযোগ করার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে যাবে। ভোট আপনাকে হয়তো কিছু দেবে না, কিন্তু আপনার ভোট কোনো একদিন একটি দেশপ্রেমিক মানুষকে নির্বাচনে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা দেবে। এটি ব্যক্তি হিসেবে আপনার অনেক বড়ো প্রাপ্তি।
আমি বলি, ভোট দিতে ন-যাওয়া মানে গণনা হতে বাদ পড়া। দেশের নাগরিক হিসেবে গণনা থেকে বাদ পড়া মরে যাওয়ার সামিল, বেঁচে থাকার মধ্যেই কি আপনি মরে যেতে চান? । তবে দেখতে হবে, যাতে আপনার ভোট আপনি স্বাধীনভাবে দিতে পারছেন। প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের ভোট সংরক্ষণ করার  উদ্যোগ নেন- তাহলে পৃথিবীর করো সাধ্য নেই আপনার ভোটে হস্তক্ষেপ করার, নির্বাচনে কারচুপি করার। সাধারণ জনগণ এত কিছু বুঝেন, কিন্তু একথাটি কেন বুঝেন না, আমি জানি না। এর একটি কারণ থাকতে পারে এবং সেটি হচ্ছে জনগণের মধ্যে ইতিবাচকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা। এটি হয়তো কোনো দলকে সাময়িকভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করাতে পারে, কিন্তু এভাবে চললে একদিন পুরো দেশটাই একদিন ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে, যাযাবরের মতো।
অনেকে ভোট দিতে যান না। তাদের অভিমত, ভোট দিয়ে কী হবে, একজনও ভালো লোক দাঁড়ায়নি, এ অবস্থায় ভোট দিতে যাওয়া মানে নিজের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া। এরকম চিন্তা করে সাধারণ্যে ভালো লোক হিসেবে পরিচিত অনেকে ভোট দিতে যান না। যারা ভোট দিতে যান না, তাদের অধিকাংশই সুশীল এবং নিরীহ, শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান ও রাজনীতিক সচেতন। এই ভালো লোকদের ভোটবৈরী মানসকিতার জন্য খারাপ লোকেরা জাতীয় সংসদে যাবার সুযোগ পায়। নির্বাচিত খারাপ লোকগুলো হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে যাওয়া হতে বিরত থাকা ভালো লোকের নিষ্ক্রিয়তার ফসল। অধিকন্তু ভালো লোকগুলো নিষ্ক্রিয় থাকে বলে খারাপ লোকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পায়। এমন লোক যতই ভালো হোক, তাদের ভালোত্ব গ্রন্থগত বিদ্যার মতো মগজেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। মগজ দিয়ে কিছুই হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা মেধা হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠে।
 ভোটে কারচুপি উন্নয়নশীল দেশের একটি মারাত্মক সমস্যা। অর্থ, ক্ষমতা আর পেশিশক্তির কাছে বন্দি হয়ে পড়ে মানুষের ভোট, নির্বাচন এবং গণতন্ত্র। ফলে ওই সব দেশে গণতন্ত্র উচ্চকিত হতে পারে না, পেশীতন্ত্রই মাথাচাড়া দিয়ে চলে। তাই জনগণের চিন্তা ক্রমশ নেতিবাচকতার দিকে এগিয়ে যায়। তারা দেশপ্রেম হতে ধীরে ধীরে সরে পরে। সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের উপর একটা ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে, ঘৃণা থেকে আসে বৈরীভাব। এই বৈরীভাব জনমনে সৃষ্টি করে হতাশা। ফলে দেশের উন্নয়ন  ও সমৃদ্ধি ব্যহত হয়। দেশ দুর্বল হয়ে পড়ে, ক্ষমতাসীন দল সাময়িক ক্ষমতার মোহে উল্লসিত হয়তো হয়, কিন্তু দীর্ঘদিন তা স্থায়ী হয় না। মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত সে তুলনায় রাষ্ট্রের জীবন অসীম।
নির্বাচনের সফলতা-ব্যর্থতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। একদল বলেন, যে দেশের অধিকাংশ জনগণ শিক্ষিত ও সচেতন নন সে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অর্থহীন। নির্বাচনের চোখে গাধা আর স্টিভেন হকিং সমান। এজন্য সক্রেটিস গণতন্ত্রকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন গণতন্ত্র মূর্খের তন্ত্র। এখানে বিড়াল আর বাঘ -দুটোকে সমগুরুত্বে মূল্যায়ন কর হয়Ñ যদি বাস্তবক্ষেত্রে তারা সমমূল্যায়িত হওয়ার যোগ্য নয়। ফলে  অধিকাংশ যোগ্য লোক বাদ পড়ে যায়। অধিকন্তু গণতন্ত্রে সাধারণত সংখ্যালঘুরাই সরকার গঠন করে, সংগত কারণে সংখ্যঘরিষ্টরা সরকারি কাজ হতে দূরে চলে যায়।
 প্রত্যেক কিছুর ভালোমন্দ দুটো দিক রয়েছে, রয়েছে সীমাবদ্ধতা। নির্বাচনেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কিন্তু এর সুবিধা, অসুবিধার চেয়ে বেশি। ক্ষমতার পরিবর্তন সাধারণত রক্তপাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যুগ যুগ ধরে এটাই চলে এসেছে, কিন্তু নির্বাচন এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে রক্তপাত ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। নির্বচন, বুলেটকে ব্যালটে নিয়ে আসে। হয়তো যথার্থ লোক নির্বাচিত হয় না, কিন্তু রক্তপাতহীন ক্ষমতা পরিবর্তনÑ এটাই বা কম কী! অতএব, ক্ষমতার রক্তপাতহীন পরিবর্তন নির্বাচনের শ্রেষ্ঠতম একটা দিক।

No comments:

Post a Comment