Tuesday 2 February 2016

আমার বন্ধু হারুন/ ড. মোহাম্মদ আমীন

হারুন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ছেলে। আকর্ষণীয় অবয়বে নিদাঘ বসন্তের মতো একজন পরিপূর্ণ মানুষ। সে আমার বন্ধু, ত্রিশ বছরের অবিরাম সখ্যতা বাংলাদেশ-আমেরিকার বিশাল দূরত্বও কমাতে পারেনি। এর কৃতিত্ব আমার নয়,
আমার বন্ধু হারুন
পুরোটাই তার। অনেক দিন পরও সে আমাকে খুঁজে নিয়েছে, ভুলে যা্য়নি। তাই আমি ভাগ্যবান, হারুনের মতো আমার একজন বন্ধু আছে। হারুনের মতো বন্ধু সহজে পাওয়া যায় না।হারুন, প্রথম পরিচয়ের মতো এখনও নির্মল হাসিটা তার অক্ষুণ্ণ আছে দিনের মতো। জ্যোস্নার মতো নিপাট স্নিগ্ধতায় মায়াভরা চোখে আদুরে আহবান লেগেই থাকে। তার লালিত্যে শিশুর মতো সারল্য, রূপোলি বিকেলের মতো উদার প্রগলভতায় জড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির মতো নিবিড় ভালবাসা। মোহমুগ্ধ একটা অনাবিল সৌন্দর্য সবসময় লেগে থাকে হারুনের মুখে, সারা অবয়বে।আমি অবাক
হারুনকে উৎসর্গিত আমার বই
হয়ে উপভোগ করি তার সব। ছোট ছোট কথায় আনন্দের ফোয়রা, নিটোল নিটোল কৌতুকে ঝরে পড়ে রাসি রাসি হাসি। মুহূর্তে জমিয়ে তুলতে পারে আড্ডা। স্মৃতিচারণেও সে জুড়িহীন। কত কথা ভুলে গিয়েছি কিন্তু সে ভুলেনি। সে-ই ত্রিশ বছর কী কম! তার কিন্তু স্মৃতি এখনও তরুণ, তরতাজা। সুখের সময়গুলোকে অতীত থেকে কাছে নিয়ে আসতে পারে কোনো সচেতন প্রয়াস ছাড়া। অতীত আর বর্তমানের সেতুবন্ধনে সময়গুলোকে বিলাসী মগ্নতায় আপ্লুত করে দেয়। হারুন, চিরদিন এমনই থেকো।
হারুন ফর্সা, লম্বা, ছিমছাম শরীর বেতের মতো সটান। অনেকটা শ্বেতাঙ্গের মতো। মুখ গোল নয়, তবে গোলাকার, অনেকটা আরবীয় ধাচ। হয়তো, তার পূর্বপুরুষ ছিলেন আরবীয় কেউ। অবশ্য আমি এ নিয়ে কখনও আলাপ করিনি। তবে আমার মনে হয়, হারুন আরবীয় রক্তজাত। চামড়ার মতো মনটাও তার ধবধবে। নিখুত, নিষ্পাপ। কখনও মুখ হতে কারও বিরুদ্ধে মন্দ বাক্য বের করে না। 
সে ধার্মিক কিন্তু গোঁড়া নয়। নিজের নীতি-আদর্শে অটল, তবে অন্যের মতাদর্শকে আঘাত করে সরাসরি কাউকে কষ্ট দিতে কখনও দেখিনি। মেনে নেওয়ার অদ্ভুদ ক্ষমতা তার মজ্জাগত। কখন কোথায়  এবং
 হারুন, হারুনের দুই কন্যা, এক মেয়ে ও বউ
কী করতে হবে, খুব বিবেচনা করে সম্পাদন করে। পরিচিতদের কাছে তাই সে একজন আগ্রহের মানুষ।তার সঙ্গে কথা বললে, তাকে আপন করে নিতে উদগ্রীব না হয়ে পারে না। আমেরিকার মতো দেশে থেকেও প্রতিবেশি ও বাঙালিদের বিপদে, সংকটে আর প্রয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে। কোনো প্রতিদান আশা করে না। এমন মানুষ কয়জন আছে? 
হারুন রাগে কিন্তু আমি বলি, রাগে না। মানে কখন কোথায় কতটুক এবং কেন রাগ করা  প্রয়োজন ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারে। তাই আবার পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। আমি এমন খুব কম মানুষে দেখেছি। রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা মানে নিজের পাশব নিকৃষ্টতাতে জবাই করতে পারার মতো কঠিন কাজ।এটিই আসল কোরবানি। এমন যারা পারে, তারাই আদর্শ মানুষ। তাই আমি বলি, হারুন একজন আদর্শ মানুষ। অমায়িকতা মানুষের সহজাত গুণ হলেও সহজে এটি পরিস্ফুট করা যায় না। অনেকে পারে না। পশুর মতো মানুষের মনে পাশবতা ভীড় করে নানা কারণে। কিন্তু হারুন পারে এবং খুব সহজে পারে। তার কাছে সহজে পাশবতা ভীড়তে পারে না, ভীড়লেও জয়লাভ করতে পারে না, মানবতাই বিজয়ী হয়। প্রকৃতির মতো লাস্যে বিরাট হাসি দিয়ে অমায়িকতাকে অকৃত্রিম বন্ধনে পরিণত করার বিরল গুণ
হারুন ও হারুনের স্ত্রী
হারুনের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার এগুণ আমাকে মুগ্ধ করে, শুধু আমাকে কেন, অনেককেই করে।বন্ধুত্ব কী এবং তাকে কীভাবে লালন করতে হয়, তার অনেক কিছু আমি হারুনের কাছ থেকে শিখেছি।
আমার কোলে হারুনের ছোট কন্যা
হারুন এখন আমেরিকায় থাকে। মাস্টার্স করে আমেরিকা চলে গিয়েছে। ভালোই করেছে, এ দেশে থেকে কী হতো! সারাক্ষণ নিরাপত্তহীনতা, চিন্তা আর সংঘর্ষ। নিউজার্সির প্রাণকেন্দ্রে সবুজ অবগুণ্ঠে সুন্দর একটা বাড়ি করেছে। সুন্দর বাড়ি মানে শুধু ইটপাথর নয়। পুরো পরিবারই নিউজার্সির প্রকৃতির মতোই নির্ঝর- হাসি, আনন্দ আর সম্প্রীতিতে ভরপুর। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকেও নিজের ভিত্তি সংস্কৃতি হতে একটুও সরে আসেনি সে। তার পরবর্তী প্রজন্মের কথা এখনও বলার সময় আসেনি। সেটি তাদের বিষয়। হারুন প্রত্যেকের স্বাধীনতায় শুধু বিশ্বাসী নয়, আকণ্ঠ নিঃশ্বাসী। কোনো কাজে তার বিরক্তি নেই, থাকলেও তা প্রকাশ না করে হাসিমুখে মেনে নেওয়ার অভাবনীয় ধৈর্য তার আছে। এমন গুণ অর্হাজন করা খুব কঠিন, লালন করা এবং প্রয়োগ করা আরও কঠিন।
হারুনের বউ আমার ‘হারুন ভাবী’ হলেও আমি ডাকি ছোট বোন। তিনি তো অতুলনীয়া। জন্ম নিয়েছেন আমেরিকায়, লেখপড়াও আমেরিকায় কিন্তু পুরো বাঙালি। তিনি উচ্চশিক্ষিত অথচ দেখলে মনে হয়, একজন সহজ-সরল বাঙালি মেয়ে। কথা বললে মনে হয় - বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজে বেড়ে ওঠা মাতৃভূমির পরশ। তিনিও ধার্মিক কিন্তু ‍উদার। ধর্ম অনেককে গোঁড়া করে দেয়, আশ্চর্যের
নিউইয়র্ক টাইমস অফিসের সামনে আমি ও হারুন
বিষয়, হারুন আর তার বউকে করেছে উদার। তাই তাদের ধর্ম একান্ত  নিজের হয়েও সার্বজনীন। তিন কন্যা তার, আমি বলি দুই কন্যা এক মেয়ে। সুযোগ পেলে ভাবী আর তিন সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন ঘুরেতে, আমেরিকা, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ- - -। এমন খুব কমজনই করতে পারে, কিন্তু হারুন করে। তার দুই কন্যা ও এক মেয়ে তার বন্ধুর মতো। 
হারুন একজন ভালো মানুষ, ভালো স্বামী, ভালো পিতা,
হারুনের উপজেলা আনোয়ারায়
আমেরিকায় থেকেও পরিপূর্ণ বাঙালি, ধার্মিক হয়েও অসাম্প্রদায়িক, সর্বোপরি একজন সহানুভূতিশীল বন্ধু। একজন আদর্শ মানুষ হতে হলে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। তাই হারুন একজন আদর্শ মানুষ। তার বন্ধুত্বে মুগ্ধ হয়ে আমি আমার ‘দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান নির্দেশিকা’ বইটা হারুনকে উৎসর্গ করেছি। তবে এখনও পাঠাতে পারিনি। আর কী দিতে পারি তাকে! আদর্শ মানুষের প্রতিভূ হারুন সবসময় ভালো থাকবে, যে কোনো অবস্থায়।