Thursday 28 January 2016

বউ এবং বউ / ড. মোহাম্মদ আমীন


রাত দুটো।
অনেকের জন্য এটি গভীর, আমরা লেখকের জন্য সন্ধ্যা। মোবাইলে হঠাৎ রিং আসে। কম্পিউটারের পর্দা হতে চোখ এবং কি-বোর্ড হতে হাত সরিয়ে মোবাইলের পর্দায় দিই।জাফর রিং করেছে। কী ব্যাপার জাফর? এত রতে!: আমি তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে। গেটটা খোল, শীতে মরে যাচ্ছি। রিক্সা ভাড়া দিতে হবে। পকেটে টাকা নেই। মানিব্যাগটা নিয়ে এসো।জাফর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিচে নেমে রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিই। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। জানুয়ারির শীত জানোয়ারের মতো চেপে ধরেছে জাফরে। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে টি শার্ট, পায়ে চপ্পল।মাধবীলতার মতো কাঁপছে।বললাম : আবার ঝগড়া হয়েছে বউয়ের সঙ্গে?সবার দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া হয়, তবে অন্যেরটা দেখে সবাই তৃপ্তি খোঁজে। এমন ভাব দেখায়, যেন ঝাগড়া কী জানেই না। আমিও তেমন একটা ভাব নিই। অবশ্য ঝগড়া হলেও আমি কারও বাসায় যায় না। বের করে দিলে ছাদে বা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। এসব বিষয় যত কম প্রকাশ করা যায় তত ভালো।বলো না কী হয়েছে?উত্তরে জাফর ঠোঁটে হাসি আনতে গিয়ে বিশাল এক দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকায়। বিষণœ চেহারা নির্যাতিত সংখ্যালঘুর মতো করুণ। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে কপোল বেয়ে কাঁধে। ধবধবে রঙের টসটসে চেহারাটা যেন ঝড়ে তছনছ সর্ষে ক্ষেত।জাফর আরও অনেক বার রাতে আমার বাসায় এসেছে। ঝগড়া হলেই বউ মাঝে মাঝে বাসা থেকে বের করে দেয়। সোজা চলে আসে আমার বাসায়। হোটেলে যাওয়া সম্ভব নয়। পুলিশের অনেক বড় অফিসার, আইজিও হয়ে যেতে পারে। রাতারাতি সব খবর চাউর হয়ে যাবে। অনেক আত্মীয়ও আছে ঢাকায়, তাদের ওখানেও যাওয়া সম্ভব নয়। সম্মান, ইজ্জত আরও কত কিছু - - -তবে এর আগে জাফরকে এমন বিমর্ষ দেখা যায়নি।বাসায় ঢুকি সন্তর্পনে, দরজা যেন আওয়াজ না-করে। আমারও বউ আছে, এখন সে ঘুমে, যদি জেগে যায়!মেয়েরা সব একই পিচ, তফাৎ কেবল ঊনিশ-বিশ।ঘরে ঢুকে একটা স্যুয়েটার হাতে দিয়ে বললাম : কী হয়েছে?কী আর হবে? ভালো লাগছিল না, তাই গল্প করতে চলে এলাম।তোমার মুখে এটা কীসের দাগ? বউ তোকে আবার মেরেছে? জাফর কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগে আবার বেজে ওঠে মোবাইল।মোবাইলের পর্দার দিকে তাকিয়ে বললম : তোমার বউ।জাফরের চেহারাটা আরও মলিন হয়ে যায়। কাঁপতে কাঁপতে আমার রিডিং রুমের সোফায় ধপাস করে বসে পড়ে।বলুন ভাবী?কোনোরূপ সম্ভাষণ ছাড়াই শুরু করেন জাফরের বউ : ভাই, হারামজাদাটা নিশ্চয় আপনার বাসায় গিয়েছে, জায়গা দেবেন না। ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন, আমিও বের করে দিয়েছি। যদি বাপের জন্মের হয়, সে আর বাসায় ফিরবে না। আপনি বলে দেবেন। ছোট লোকের বাচ্চা, জাফর নয়, মীরজাফর, ঘসেটি বেগমের  গোষ্ঠী। সাবধান! সে কিন্তু আপনার বাসাটাকেও ধ্বংস করে দেবে। এদেও বংশ হায়েনার  চেয়ে ভয়ঙ্কর। কুকুরের চেয়েও অধম, আকৃতিটা ছাড়া মানুষের কিছু  নেই। আমি তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করব, সব গোপন কথা ফাঁস করে দেব। তার ধ্বংসই আমার কামনা। অসভ্যটা একদিনের জন্যও শান্তি দেইনি। পুলিশের চাকরি করে আর খালি ঘুষ খায়। অফিস থেকে এসেই বলে, ভাত দাও। কেন? আমি ভাত দেব কেন? সে ভাই নিয়ে খেতে পারে না! আমি কী তার চাকরনী! ভাই আপনারাও তো অফিস করেন। কোনোদিন বউকে ভাত দিতে বলেছেন? ভাবী আপনার কত প্রশংস করে, বলে “আমাকে কোনোদিন ভাত দিতে বলে না, দিলে দিলাম না দিলে না-দিলাম”।  আমি কেন তাকে ভাত দেব? চাকর্নিরাই এসব করে। ভাই, ঘরে চাকর্নি রেখেও শান্তি নেই। আমার চেয়ে চাকর-বাকরদের প্রতি তার বেশি মায়া। কাজের বুয়াদের একটু বকাঝকা করলে দরদ উতলে ওঠে। বুঝি না, কেন এত দরদ। ভাই, যত তাড়াতাড়ি পারেন তাকে বিদায় করেন।ভাবী, জাফর ভাই তো - - -ভাই, আপনারাও তো সংসারে করেন, এমন তো হয় না, হয় কী? সে একটা জানোয়ার। বাপ ছিল ফকিন্নি, মা ছিল গ-মূর্খ। ভাইগুলো চাষাভূষা, বোনগুলো বেশ্যা। এমন জঘন্য পরিবারের ছেলে কীভাবে ভালো হয়? আমার মা-বাবা এমন নিকৃষ্ট পরিবারের একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে জীবনটা বরবাদ করে দিল। এতক্ষণে সে মনে হয় আমার বিরুদ্ধে অনেক আজেবাজে কথা বলে দিয়েছে। আমি কিন্তু ভাই বেশি কথা পছন্দ করি না। হারামির বাচ্চাটা মরে না কেন? সে যদি মরতো, বিশ্বাস করেন ভাই, আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। মসজিদে শিরনি দিতাম। কত লোক রাস্তায় কতভাবে অ্যাক্সিডেন্টে মরে, সে কেন মরে না! কুত্তার বাচ্চা বাসায় আসুক, জিব কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দেব। তাকে খুন করে আমি হাজতে যেতেও প্রস্তুত।- - - - - কৃপণের পুত - - -- ।কী হয়েছে ভাবী? আমি আবার জানতে চাইলাম।জাফর ভাবী : ঘটনা বললে তো ভাই আপনি আকাশ থেকে পড়বেন। যে কথা বলেছে, সেটা আপনার স্ত্রী যদি বলতেন, তাকে আপনি এতক্ষণে জবাই করে দিতেন। আমি তো কেবল ঘর হতে বের করে দিয়েছি।বলেন না ভাবী, কী বলেছে।জাফর ভাবী : নটির বাচ্চা - বলে কিনা আমি বেশি কথা বলি। -- -- -- ভাই আমি কি বেশি কথা বলি?না, না ভাবী, আপনি ভালো।জাফর মিয়া তো সেটা বুঝে না।ততক্ষণে আমার স্ত্রী চলে আসে। ভাগ্য ভালো, আমার মোবাইলের চার্জও শেষ হয়ে যায়। জাফরের দিকে তাকিয়ে হায় হায় করে উঠে আমার স্ত্রী : ভাই, আপনাকে কী এক কাপড়ে বের করে দিয়েছেন ভাবী?দৌঁড়ে গিয়ে একটা চাদর এনে দেয় জাফরের হাতে।লাগবে না। স্যুয়েটার পড়েছি তো।পড়–ন, যে শীত পড়ছে, শুধু স্যুয়েটারে কী শীত মানায়? এত রাতে বাইর থেকে এসেছেন, সর্দি লেগে যাবে, সর্দি হতে নিউমোনিয়া। এ বয়সে নিউমোনিয়া হলে বাঁচবেন না।আমি নিজের দিকে তাকাই। আমার গায়েও কেবল স্যুয়েটার, কোনো চাদও নেই। অবশ্য আমি জাফরের মতো বাহিত হতে আসিনি। এত ঈর্ষা করা ভালো নয়।চাদর এনে জাফরের হাতে দিয়ে বলল : ভাই, আপনার মুখ এত শুকনো কেন? নিশ্চয় সারাদিন কিছু খাননি?  আমি খাবার নিয়ে আসছি।না, ভাবী লাগবে না।না বললেই হলো? আমাকে এত নিষ্ঠুর ভাববেন না। এত রাতে না-খাইয়ে এক কাপড়ে বাসা হতে বের করে দিয়ে ভাবী কাজটা মোটেও ভালো করেননি। কীভাবে যে, মেয়েরা স্বামীদের সঙ্গে এত খারাপ আচরণ করে বুঝি না।খুট করে আমার মুখে একটু আদর টেনে দিয়ে বউ আমার রান্না ঘরে চলে যায়।কিছুক্ষণের মধ্যে গরম গরম খাবার চলে আসে। জাফরকে একপ্রকার জোর করে ডাইনিং রুমে নিয়ে যায় আমার বউ। আমিও যাই।জাফর বলল : আসো একসঙ্গে খাই, ভাবী আপনিও বসেন।না ভাই, আমি খেয়েছি।জাফর আমার দিকে তাকায় : মুখ বলছে তুমি ক্ষুধার্থ।বউ বলল : তুমি রাতে খাওনি?আমি বউয়ের দিকে তাকাই, বুঝতে পারছি না কী উত্তর দেব, কী উত্তর দেওয়া উচিত।

No comments:

Post a Comment